bih.button.backtotop.text

একটি সুন্দর ব্যথা: একজন রোগীর কেমোথেরাপির যাত্রা

“যদিও কেমোথেরাপি অনেক কষ্টকর একটি চিকিৎসা, কেননা এর ফলে মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, রুচি কমে আসার মতো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও একটি বিষয় আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে; আমার মেয়ের কাছে ফিরে যাওয়া এবং আমার নাতিকে দেখা। তারাই আমার জীবনের সবকিছু। তারাই একমাত্র কারণ, যাদের কথা ভেবে আমি আমার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পেরেছি”। এই কথাগুলো 62 বছর বয়সী মিসেস রাজিয়া নাসরিন সুলতানার। তিনি বাংলাদেশ থেকে আগত ব্রেস্ট-ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন রোগী। অশ্রু-ভেজা চোখে এবং হাস্যোজ্জল মুখে  নির্ভীকভাবে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে গেছেন শুধুমাত্র তার পরিবারের সবার মুখে হাঁসি ফোটানোর জন্য।  

বাংলাদেশ থেকে আগত ব্রেস্ট-ক্যান্সারে আক্রান্ত 62 বছর বয়সী মিসেস রাজিয়া নাসরিন সুলতানা তিন বছর আগে ক্যান্সারের সাথে তার লড়াই শুরু করেন। সেসময় তিনি কানাডাতে তার মেয়ের সাথে দেখা করতে যান এবং তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন। ডাক্তার তার সমস্যাগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং তাকে শুধুমাত্র নিউমোনিয়া ভ্যাক্সিন নেয়ার পরামর্শ দেন, কেননা তার হাঁপানি রোগ ছিল।

“বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন চলাকালীন শেষ সময়ের দিকে আমি কানাডা থেকে দেশে ফিরি। ফলে আমার কাজগুলো আরও কঠিন হয়ে যায়। আমি আবারও অসুস্থ হয়ে পরি”। তিনি ঠিক কোন সময় আরও ভালোভাবে চেক-আপ শুরু করেন সেটি তুলে ধরেন এবং সেই প্রেক্ষিতে বলেন যে, “আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে পূর্বের লক্ষণগুলো আমার এই গুরুতর অবস্থার আভাস ছিল”।

“আমি একের পর এক নানান ধরণের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছি। শেষমেশ আমি একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাই এবং তিনি আমাকে একটি ম্যামোগ্রাম পরীক্ষা করার জন্য জোর দেন। এসময় আমি কিছুটা ভয় পেয়ে যাই কেননা বার বার আমাকে নানান ধরণের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরবর্তীতে আমাকে একজন ব্রেস্ট সার্জনের কাছে পাঠানো হয় এবং তিনি বললেন আমি খুব সম্ভবত ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছি, কিন্তু তিনি এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না”।

মিসেস রাজিয়া পরবর্তীতে বাংলাদেশের ওয়ার্ল্ড ব্যাংক অফিসের হেলথ সাপোর্ট সার্ভিস (স্বাস্থ্য সহায়তা পরিষেবা)-এর সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। এই ব্যাংকে তিনি দীর্ঘ 25 বছর কর্মরত ছিলেন। তার কর্মচারী স্বাস্থ্য বীমার সুবাদে তিনি সিঙ্গাপুর অথবা ব্যাংককে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করার জন্য অনুমোদিত আছেন। তার সকল পরীক্ষার রেকর্ড এবং ফলাফল দেখার পর হেলথ সাপোর্ট সার্ভিস
(স্বাস্থ্য সহায়তা পরিষেবা) অবিলম্বে তাকে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে (Bumrungrad International Hospital) চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য পরামর্শ দেন তারা পূর্বেও তার আরও বেশ কয়েকজন সহকর্মীদের সেখানে চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য পরামর্শ দেন আরেকটি উল্লেখ্য বিষয় হলএখানে সিঙ্গাপুরের তুলনায় চিকিৎসা খরচ অনেক কম

14 ফেব্রুয়ারি মিসেস রাজিয়া বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালের (Bumrungrad International Hospital) হরাইজোন ক্যান্সার সেন্টারে পৌঁছান। তার সাথে ছিলেন Dr. Piyawan Kensakoo (ড্র. পিয়াওয়ান কেনসাকো)। তিনি একজন ব্রেস্ট সার্জিকাল অনকোলজিস্ট। “ডাক্তার বলেন যে তিনি 98% নিশ্চিত যে আমি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলাম। এটি শুনে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। তাহলে কী আমার সত্যিই ক্যান্সার আছে”? ঘটনাটি স্মরণ করতেই তার মুখ জুড়ে উদ্বেগের ছায়া ছড়িয়ে পড়লো। তিনি আরও আতঙ্কিত হয়ে পরলেন যখন জানতে পারলেন যে তার ক্যান্সার লিম্ফ নোড পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে, কেননা এধরণের রোগীদের ক্ষেত্রে ফলাফল খুব একটা ইতিবাচক হয় না।


চিকিৎসা এখন খুবই সহজ

Dr. Piyanoot Jitthiang (ডক্টর পিয়ানুত জিথিয়াং) মিসেস রাজিয়ার কেমোথেরাপি চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি একজন মেডিকেল অনকোলজিস্ট।

“আমার কেমোথেরাপি ছয়টি ধাপে সম্পন্ন হয় এবং এর প্রতিটিই আমি দাঁত চেপে সহ্য করেছি। কেমোথেরাপির চতুর্থ ধাপের সময় আমি খুবই দুর্বল হয়ে পরি এবং মনোবল হারিয়ে ফেলি। এতো সব দুর্দশার মাঝেও আমার ডাক্তার এবং তার পুরো টিম এতো ভালোভাবে আমার যত্ন নিয়েছেন যে এসব ব্যথার মাঝেও আমার ভালো লাগার একটি জায়গা ছিলেন তারা। তারা কখনোই আমাকে নিরাশ করেননি”।

“আমি নিয়মিতই ঢাকায় আমার বাসা থেকে ব্যাংককের হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতাম। আমি যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছি, বিশেষ করে কাজের ক্ষেত্রে। আমি যে ধরণের কাজ করিসেই কাজে টিম ওয়ার্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মুখোমুখি যোগাযোগ অপরিহার্য একটি বিষয়। কিছু সমস্যার সমাধান পুরো টিমের একত্রিত হয়ে সমাধান করতে হয়”। মিসেস রাজিয়া তার নিজের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এবং তার চিকিৎসাধীন হাসপাতালের মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমের কাজের ধরণের সাথে সাদৃশ্যতা তুলনা করার সময় এই কথাগুলো বলেন।   


হাঁসির মাধ্যমে ব্যথার পরিসমাপ্তি

 
জুলাই মাসে মিসেস রাজিয়া সার্জারির পূর্বে তার সর্বশেষ কেমোথেরাপি সম্পন্ন করেন। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার সময় তিনি তার স্বামীকে সরাসরি তাদের হাসপাতালের জরুরী কক্ষে নিয়ে যেতে বললেন। “আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো, আমার খুব ভয়ও লাগছিল। হাসপাতালে পৌঁছানোর সাথে সাথেই রক্ত পরীক্ষা করার জন্য আমার রক্ত নেয়া হয়। Dr. Piyanoot (ডক্টর পিয়ানুত)-কে জরুরী ভিত্তিতে ডাকা হয়”। ডাক্তার আসার সাথে সাথেই তিনি জরুরী কক্ষের কর্মীদের নির্দেশ দিলেন যে তারা যেন কোনো অবস্থাতেই মিসেস রাজিয়াকে একা রেখে না যায়।   

“এরপর কি হয়েছে তার কিছুই আমার মনে নেই। পরবর্তী যে বিষয়টি আমি মনে করতে পারছি তা হল- ডাক্তার আমার স্বামীকে বলছিলেন যে আমার অবস্থা খুবই গুরুতর ছিল। তিনি আমাকে বোঝালেন যে কিছু পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। আমি সবকিছুই বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু আমার মধ্যে কিছু বলার মতো কোনো শক্তি ছিল না”।

“আরও প্রায় ছয় সপ্তাহ পর আমার মধ্যে শক্তি ফিরে আসে এবং আমি সার্জারি করার জন্য প্রস্তুত হই। সবকিছু ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়। সবাই খুবই পেশাগতভাবে কাজ করেছে। টিস্যু স্যাম্পল টেস্টের ফলাফল আসার জন্য আমি আরও কিছু সময় অপেক্ষা করলাম। যখন আমি টেস্টগুলোর রেজাল্ট দেখলাম,
তখন সেগুলো আমার বিশ্বাস করতে একটু কষ্টই হচ্ছিলো। এই অগ্নিপরীক্ষা কি সত্যিই শেষ হতে যাচ্ছে? Dr. Piyanoot (ডক্টর পিয়ানুত) আমার হাত ধরে বললেন যে, আমি এখন ক্যান্সার থেকে মুক্ত। মেডিকেল এবং সার্জিকাল অনকোলজি টিম অসম্ভবকে সম্ভব করেছে এবং অবশেষে আমাকে ক্যান্সার থেকে মুক্তি দিয়েছে। আমি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে এই প্রথম এতোটা আনন্দ অনুভব করছি, কথাগুলো মিসেস রাজিয়া এই সাক্ষাত্কারের একদিন আগে ঘটে যাওয়া এই সুখময় ও স্বাচ্ছন্দ্যের কথা জানান।


কেমোথেরাপিপ্রাণ দানকারী বিষ

 
“প্রথম যখন আমি জানতে পারি যে আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত আমি অনলাইনে কেমোথেরাপি নিয়ে অনেক গবেষণা করি, এবং বুঝতে পারি এর থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। নিঃসন্দেহে এটি একটি বিষ। চোখের পানি মুছতে মুছতে মিসেস রাজিয়া বলেন যে, “যদিও কেমোথেরাপি অনেক কষ্টকর একটি চিকিৎসা, কেননা এর ফলে মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, রুচি কমে আসার মতো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও একটি বিষয় আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে; আমার মেয়ের কাছে ফিরে যাওয়া এবং আমার নাতিকে দেখা। তারাই আমার জীবনের সবকিছু। তারাই একমাত্র কারণ, যাদের কথা ভেবে আমি আমার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পেরেছি।”

এই সাক্ষাৎকারটি দেয়ার পরদিন তার মেয়ে তার সাথে দেখা করতে ব্যাংকক যাবে। কান্নার মাঝেও তার মুখে হাঁসি থাকার এটিই প্রধান কারণ। অন্যান্য ক্যান্সার রোগীদের উৎসাহ দিয়ে তিনি বলেন যে, “আমি যেরকম অসুস্থতার মধ্যে জীবনযাপন করেছি এরকম পরিস্থিতিতে যদি অন্য কাউকে পরতে হয়, তাহলে আমি তাকে বলবো তার পরিবারের কথা ভাবতে। আপনার ভালোবাসার সব মানুষই চাইবে আপনি যেন সুস্থ হয়ে তাদের কাছে ফিরে যান এবং একত্রে জীবন কাটাতে পারেন। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করছি কারণ আমার পরিবার, আমার সন্তান এবং নাতি সবসময় আমাকে ভালোবাসা এবং অনুপ্রেরণা দিয়ে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছে।

 সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, আপনি যদি বুঝতে পারেন বা অবগত হন যে আপনি ক্যান্সারে আক্রান্ত তাহলে আপনাকে অবশ্যই অবিলম্বে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। এক মুহূর্তও দেড়ি করবেন না, কেননা সেই এক মুহূর্তের কারণেও আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষদের কাছ থেকে সারা জীবনের জন্য দূরে সরে যেতে পারেন।”
For more information please contact:

Related Packages

Related Health Blogs