bih.button.backtotop.text

বিশ্ব ক্যান্সার দিবস: সকলে মিলে ক্যান্সার মুক্ত একটি জগতে প্রবেশ

একুশ শতকের এই যুগে ক্যান্সারই আমাদের জীবনের সবথেকে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম অবস্থা বজায় থাকলে ক্যান্সার খুব শীঘ্রই হৃদরোগকে হার মানিয়ে দিবে যেটি কিনা মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী এক নম্বর রোগ হিসেবে পরিচিত। আমাদের মধ্যে অধিকাংশই কোনো না কোনো ভাবে ক্যান্সারের সম্মুখীন হয়েছে; অর্থাৎ আমাদের পরিচিত কেউ না কেউ আছেনই যিনি কিনা ক্যান্সারে আক্রান্ত বা পূর্বে আক্রান্ত ছিল। 2000 সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সামিটে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিনিধি সম্মিলিতভাবে 4 ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, ক্যান্সারের বিভিন্নতাকে বোঝা এবং সেই সাথে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে এই সমস্যাটি সম্পর্কে অবগত করা।

ক্যান্সার কতোটা সন্নিকটে?
 
1990 সাল থেকে করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছরে নতুন 8.1 মিলিয়ন ক্যান্সারে আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যায়। 2018 সাল নাগাদ বছরে 18.1 মিলিয়ন নতুন রোগীর তথ্য পাওয়া যায়। প্রচলিত ক্যান্সার সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যথাক্রমে ফুসফুস, স্তন ও অন্ত্রের ক্যান্সার। বৈশ্বিকভাবে এই বিষয়কে গুরুত্বের সাথে যদি এখনই না নেওয়া হয় তবে ধারণা করা যায় যে 2030 সাল নাগাদ বছরে ক্যান্সার জনিত মৃত্যুর সংখ্যা 13.1 মিলিয়নে দাঁড়াবে।

যদিও বর্তমানে মানুষের মধ্যে পাওয়া ক্যান্সারের 40% এরও বেশি নিরাময়যোগ্য এবং আক্রান্ত রোগীর বেঁচে যাওয়ার সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিগত দশক ধরে ক্যান্সার নিয়ে পড়াশোনা এবং একে বোঝার ফলস্বরূপ সম্ভবত এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন সম্ভাবনারও জন্ম দিয়েছে। ক্যান্সার নির্ণয়, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি দেখা যায় তা রোগীদের ক্যান্সারের সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আস্থা দেয়।

ধাপ 1: প্রতিরোধই সর্বসেরা ঔষধ
স্বাস্থ্যের যত্ন এবং সঠিকভাবে খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকদল ক্যান্সারকে প্রতিহত করতেও যথাযথভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান। আমাদের হাতে আছে এখন সার্ভিকাল ক্যান্সারের ভ্যাকসিন (এইচপিভি) যা একযোগে 9-44 বছর বয়সী রোগীদের আজীবন সুরক্ষার জন্য দেওয়া হয় (রোগীর বয়স অনুযায়ী পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে)। এই ভ্যাক্সিন মূলত সার্ভিকাল ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং পুরুষদের  যৌনাঙ্গের জড়ুল ও মলদ্বারের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
 
আমাদের প্রসারিত জ্ঞান ক্যান্সারকে সঠিকভাবে আঘাত হানতে আমাদের সাহায্য করছে। উদাহরণস্বরূপ, ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি কারণ হচ্ছে সিগারেটের কালো ধোঁয়া যা জানার ফলে মানুষ ধূমপান ত্যাগ করছে বা বায়ুদূষণ আছে এমন স্থান পরিত্যাগ করছে। এই জ্ঞান থাকার কারণে মানুষ দূষণ রোধে মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে আবার স্কিন ক্যান্সার রোধে সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে বাঁচতে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরছে।

ধাপ 2: দ্রুত সতর্কতাই সাফল্যের চাবিকাঠি
ক্যান্সারের জটিলতাগুলো আমাদের বোঝায় যে আমাদের স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ যত্ন নিলেও ক্যান্সার হতে পারে। আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতাও বাড়তে পারে। কিন্তু ক্যান্সার অন্য সকল অসুখের মতই যত তাড়াতাড়ি নির্ণয় করা যাবে তত সহজেই তার চিকিৎসা সম্ভব হবে। সহজ ও কার্যকরী স্ক্রিনিং পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে যা বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে:
স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে ম্যামোগ্রাম সর্বোচ্চ মানের পদ্ধতি। 40 বছর বা ততোধিক বয়সী মহিলাদের (বা তার চেয়ে কম বয়সী যদি পরিবারে ক্যান্সারের কোন পূর্ববর্তী ঘটনা থাকে) প্রতি 1-2 বছরে ম্যামোগ্রাম করানোর কথা বলা হয়ে থাকে।

ফুসফুসের এক্স-রে - ইতোমধ্যে বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার একটি অংশ- যা ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় এবং যক্ষ্মা নির্ণয়ে সহায়তা করে।
সার্ভিকাল ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভাইরাস স্ক্রিনিং এর জন্য একটি প্যাপ স্মিয়ার সাথে এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট করা হয়ে থাকে। 30-65 বছর বয়সী মহিলাদের প্রতি 5 বছরে একবার এই পরীক্ষা করানো উচিত।
কোলনস্কপি কোলন এবং মলদ্বারের ক্যান্সার নির্ণয়ে করা হয়ে থাকে যা 45 বছর বা ততোধিক বয়সী নারী পুরুষ উভয়েরই করানো উচিত।
প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পিএসএ লেভেল নির্ণয় করা হয়। এটি পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষদের করানোর জন্য বলা হয়ে থাকে।
এছাড়াও এর মাধ্যমে আপনি আপনার শরীর সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন। যদি আপনি আপনার শরীরে কোনো অস্বাভাবিকতা, যেমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক বড় ফোঁড়া বা দাগ বা আপনার অন্ত্রের চোখে পরার মতোন কোনো পরিবর্তন দেখতে পান তবে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।


ধাপ 3: চিকিৎসার এক বিশাল জগত
যদিও ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সেই সাথে ক্যান্সার থেকে আরোগ্য পাওয়া লোকদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে ক্যান্সার সনাক্তকরণে পারদর্শীতা বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন চিকিৎসার আবির্ভাব যা পূর্বে ছিল না। বর্তমান সময়ে শুরুতেই যদি ক্যান্সার সনাক্ত করা যায় তাহলে সেটি খুব সহজেই সফলভাবে চিকিৎসা করা যায়। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, বিগত 20 বছরে স্তন ক্যান্সারের আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে (1996 সালে প্রতি 100,000 নারীর মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল 29.4, যা 2016 সালে 20 জনে নেমে এসেছে)। মেটাস্ট্যাটিক লাঙ্গ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পূর্বে কেবলমাত্র 5%-এর ক্ষেত্রে আরও পাঁচ বছরের মতন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকতো, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে 15-20%-এ দাঁড়িয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র ইমিউন চেকপয়েন্ট থেরাপির মাধ্যমে।

 বিগত সময়গুলোতে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোই রোগীদের মধ্যে ভয় এবং উদ্বেগের মূল কারণ ছিল, কেননা এগুলোর ফলে রোগীদের জীবন-মাণ অনেকটাই হ্রাস পেতো। কিন্তু বর্তমানে উন্নত মাণের কেমোথেরাপি অনেকটাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত। বর্তমানে টার্গেটেড থেরাপি ব্যবহার করা হয়, যা শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষগুলোকে আক্রমণ করে। এদের কার্যকারিতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পরিমাণও কমে যাবে। এমনকি এই টার্গেটেড থেরাপি অনেক জটিল ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত কার্যকরী। যেমন- প্রোস্টেট ক্যান্সার অথবা সারকোমা ক্যান্সার।

আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাস করেন, ধনী বা গরীব যাই হয়ে থাকেন, কোনো উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বা শরণার্থী যেটিই হয়ে থাকেন না কেন, ক্যান্সার সবার জন্যই সমানভাবে একটি বিশাল আকারের হুমকি। বিশ্ব ক্যান্সার দিবস এমনই একটি দিন যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা এখনো আমাদের মধ্যে আশার আলো বাঁচিয়ে রাখতে পারি এবং সচেতনতা সৃষ্টি, সজাগ থাকা এবং চিকিৎসা নিয়ে তৎপর থাকার মাধ্যমে যখন ক্যান্সার যথাসময়ে সনাক্ত করা হয় এবং সেই সাথে সুষ্ঠু যত্ন ও সেবার দ্বারা সবগুলো স্বপ্নই জীবিত থাকবে এবং ভবিষ্যৎ আশার আলো সহজেই ছোঁয়া যাবে। আপনার পরিচয় যাই হোক, বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে একটিই নীতিবাক্য হবে, “আমি পারি এবং আমি পারবো” এবং সম্মিলিতভাবে ক্যান্সারমুক্ত একটি জগত তৈরিতে এটিই আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী হবে।


 
For more information please contact:
Last modify: মে 15, 2025

Related Packages

Related Health Blogs